খুলনা বিভাগের আসপাশের দশটি জেলা থেকে দুতিনদিন আগে থেকেই শহরের দৌলতপুর ও খালিশপুরসহ অন্যান্য এলাকায় এসে জড়ো হয়েছিলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সবগুলো জেলা থেকেই মানুষ এসে যোগ দেয় এই জনসভায়।
শুক্রবার রাত বারোটার দিকে তারা শহরের সোনালী ব্যাংক চত্বরে এসে জড়ো হতে শুরু করেন, যেখানে তৈরি করা হয়েছে সভামঞ্চ। সকাল থেকেই খুলনা শহর পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। রাস্তাঘাটগুলো ছিল বিএনপি নেতাকর্মীতে পূর্ণ। বিএনপি নেতারা বলছেন রিকশা, ইজিবাইক কিংবা পায়ে হেঁটে যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবেই খুলনা অভিমুখে আসেন।
খুলনা শহর থেকে প্রায় একশ বিশ কিলোমিটার দূরের ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম ফিরোজের নেতৃত্বে একটি মিছিল সকাল দশটার দিকে শহরে এসে পৌঁছে। তিনি বলেন, তার নেতাকর্মীরা প্রায় ৫০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে শহরে এসেছে। ‘সব বন্ধ করে দিয়েছে কাল থেকে। তাও যে যেভাবে পেরেছে এসেছে। শেষ পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে।
সমাবেশে থেকে বিএনপির নেতারা চারটি দাবি তুলে ধরেন: এক. খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, দুই. নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, তিন. জ্বালানি তেল ও জিনিসপত্রের দামের উর্দ্ধগতির নিয়ন্ত্রণ, চার. নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা
চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহের মতো খুলনার সমাবেশের মঞ্চেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সম্মানে একটি চেয়ার খালি রাখা হয়। এর উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) আমাদের বলেছেন যে তোমরা সঠিক পথে আছ, এভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাও। জনগণের অধিকারকে আদায় করে নিয়ে আসো। সে জন্যই তার সম্মানে এ চেয়ার খালি রাখা হয়েছে।’
সমাবেশে সরকারের বাধা দেবার বিষয়টি উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সীমাহীন বাধা দিয়েছে। আমি পুলিশ প্রশাসনের ভাইদের বলতে চাই, আপনাদের ফোন করলে বলেন, না সব ঠিক আছে। আজকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমরা তো বিএনপির সমাবেশে বাধা দিই না; বরং সহযোগিতা করি।’ কী সহযোগিতা করেছেন? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে সে প্রশ্ন রেখে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘স্টেশনে নামার পরে আমাদের ছেলেদের গ্রেপ্তার করেছেন। আমাদের চোখের সামনে আমাদের ছেলেমেয়েদের কুপিয়েছে, আপনারা কিছুই বলেননি। বরং খেয়াঘাটে গ্রেপ্তার করেছেন, আহত করেছেন। যাতে সমাবেশে যোগ দিতে না পারে, তার ব্যবস্থা করেছেন। তারপরও তারা পারেনি।’
খুলনাবাসীকে অভিবাদন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই সভা প্রতীক মাত্র। খালেদা জিয়ার চেয়ার খালি। তিনি গৃহবন্দি। তাঁর স্মরণে এই চেয়ার খালি। জনতার সৈনিক, জনগণের অধিকার ফিরিয়ে নিয়ে আসো। এই দেশকে নরকে পরিণত করেছে সরকার। সব অর্জন ধ্বংস করে ফেলেছে। অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে এসব করছে সরকার। একবার ভোট ছাড়া, আরেকবার নিশি রাতে। ২০২৩ সালে নির্বাচন একইভাবে করার পায়তারা।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন নিজেদের ভালো দেখানোর জন্য কৌশল নিয়েছে। কমিশনকে তো ডিসি-এসপিই মানে না। তাই আমরা নির্বাচন কমিশন নিয়ে কথা বলছি না। তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়। তাই এই সরকারকে বিদায় জানাতে হবে।’
মামলা হামলায় বিএনপিকে দমানো যাবে না বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল খুলনার সমাবেশে বলেন, ‘নতুন সাহস নিয়ে আন্দোলন করছে বিএনপি।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সরকার বলছে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনির কথা। কারণ তারা লুটপাট করছে। সরকার বলছে সমাবেশে সহায়তার কথা। স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী কি সহায়তা করেছেন, রেলস্টেশনে গ্রেপ্তার হামলা করা হয়েছে। আপনারা দমিয়ে রাখতে পারবেন না। বিএনপি নতুন সাহসে বলীয়ান, আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বয়স হয়েছে তারপরও লড়াই করছি। মূল দায়িত্ব তরুণদের উপরে, লড়াইয়ে জিততে হবে। আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি করছি, সহিসংসতা করছি না। আমাদের উপর হামলা করে পার পাবেন না। বিদেশিরা বুঝে গেছে, আপনারা সন্ত্রাসের দল। হামলা করে ক্ষমতায় টিকে আছেন।
নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আপনারা অসাধ্যকে সাধন করেছেন। তিন দিন ধরে জলে–স্থলে সব পরিবহন বন্ধ করে দিয়েছে। দুই দিন ধরে বাস বন্ধ, লঞ্চ বন্ধ করেছে, নৌকা বন্ধ করেছে, খেয়াঘাট বন্ধ করেছে। কিছুই চলতে দেয়নি। তারপরও কি আপনাদের গণতন্ত্রের যে আকাঙক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই, সে লড়াইয়ে বাধা দিতে পেরেছে? ইতিহাস বলে, কোনো দিন জনগণের ন্যায়সংগত দাবি উপেক্ষা করে শুধু শক্তি দিয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মানুষকে দমিয়ে রাখা যায় না। সেটিই আপনারা আবার প্রমাণ করেছেন।’
বিএনপির মহাসচিব জানান, গত দু-তিন দিনে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হাজারো নেতা-কর্মীকে আহত করেছে। রূপনগরে ২০ জন গুলিবিদ্ধ, কেশবপুরে ১৫ জন গুলিবিদ্ধ, মোংলায় ট্রলারে আসা প্রায় ১০০ নেতা-কর্মীকে আহত করে ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। রূপসা, তেরখাদা ও দিঘলিয়ায় ১০০ নেতা-কর্মীকে আহত করেছে। বাগেরহাটের মিছিলে ৭০ নেতা-কর্মীকে আহত করেছে। গ্রেপ্তার করেছে ৫০ জনকে। নগরের ৫ ও ৭ নম্বর ঘাটে আসা ট্রলার ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন কর্মীকে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। খুলনা রেলস্টেশনে নেতা-কর্মীদের মারধর করা হয়েছে, গত দুই দিনে হোন্ডা মহড়া দিয়েছে হকিস্টিক উঁচিয়ে। রামপাল-কাটাখালীতে হামলা হয়েছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, এই যে এত মানুষ আহত হলো, এত মানুষ গ্রেপ্তার হলো, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হলো। এটা কেন? এ প্রশ্ন রেখে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজকের এই সভা একটা প্রতীক মাত্র। এই প্রতীক হচ্ছে আমাদের ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, বাসস্থানের অধিকার। সেই অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এই সভা।’
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘আমাদের সামনে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। এই সরকারকে পরাজিত করে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার পদত্যাগ করুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের চিহ্ন থাকবে না ১০টার বেশি আসন পাবে না। গণঅভ্যুত্থানে এ সরকারকে বিদায় জানাতে হবে। আমাদের দেশকে গণতন্ত্রের পথে ফেরাতে চাই। ফয়সালা হবে রাজপথে। আদালত ঠিক করতে কমিশন গঠন করব। এখনও সময় আছে সেইফ এক্সিট নেন। পালাবার পথে খুঁজে পাবেন না।’
দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বিদ্যুতের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। ছয় ঘণ্টা থেকে আট ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরাতো শান্তিপূর্ণ লড়াই করছি। কিন্তু আমাদের সমাবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাধা দেয়া হচ্ছে। বাধা দিয়ে আর আমাদের আটকে রাখা যাবে না। মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। দাবি আদায় করেই ঘরে ফিরবে। বক্তৃতায় বিএনপি মহাসচিব তার দল ক্ষমতায় গেলে কি করবে এমন কিছু প্রতিশ্রুতিও তুলে ধরেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাকি লোডশেডিং বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাহলে এখন কী হচ্ছে। দেশে সামনের বছর দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। আপনারা দ্রুত পদত্যাগ করুন। আর না হয় স্বৈরচারী সরকারকে দেশের জনগণ টেনে হিঁচড়ে নামাবে।’ আজ শনিবার বিকেলে খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘খুলনা বিভাগীয় সমাবেশ সরকারের স্বৈরাচারী আচরণের কারণে আরও বেশি সফল হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে যখন হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়ে, তখন কোথায় ছিল আওয়ামী লীগ। সেসময় জিয়াউর রহমান দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।’
গণসমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, ‘খুলনায় মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে এই সরকারকে জনগণ আর চায় না। বিএনপি খুলনা বিভাগে যে গণসমাবেশ ডেকেছে তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারে যেমন যতদূর দৃষ্টি যায়, পানি দেখা যায়। আজকে যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। ভয় পেয়ে সরকার দুই দিনের হরতাল ডেকেছে। যেখানে সারাবিশ্বে বিরোধীদল সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে হরতাল ডাকে, সেখানে বাংলাদেশের সরকার নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে হরতাল ডেকেছে। আমরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, আওয়ামী লীগের অধীনে আর কোনো নির্বাচন হবে না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমাদের খুলনা জেলার প্রতিজন নেতাকর্মীকে ধন্যবাদ জানাই। শত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে তারা সমবেত হয়েছেন। এই সমাবেশকে কেন্দ্র করে আমাদের বিভন্ন জেলা-উপজেলার ২০০ নেতাকর্মীকে পুলিশ আটক করেছে। পথে পথে হামলা হয়েছে। এই হামলা পুলিশ ও শেখ হাসিনার পেটোয়া বাহিনী চালিয়েছে। শেখ হাসিনার এক চাচীর ছেলে হুংকার দিয়ে বলেছেন, পদ্মার এপারে বিএনপি দাঁড়াতে পারবে না। আমি শেখ হাসিনাকে বলব, উনার চাচীর বড় ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি নাকি আমাদের নামতে দেবেন না। খুলনার বিভিন্ন রাস্তায় আমাদের নেতাকর্মীরা পাটি বিছিয়ে রাতভর রাজপথ পাহারা দিয়েছে।
Leave a Reply