দীর্ঘকাল ধরে উন্নয়নশীল বিশ্ব তাদের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী এমনকি জাতীয় রাজনীতি পরিচালনা করে প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, রাশিয়ার মতো সুপার বা আঞ্চলিক শক্তির নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে। ঔপনিবেশিক যুগ থেকে এই প্রবণতা চলে আসছে। বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলির মানিয়ে নেওয়া জরুরি। স্নায়ুযুদ্ধ যেমন অতীতে বিশ্বকে বিভক্ত করেছিল, তেমনি বর্তমানে বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষমতার প্রতি লোভ অদূর ভবিষ্যতেও উন্নয়নশীল বিশ্বকে এমন একটি ফাঁদে ফেলতে পারে। এশিয়ান মূল্যবোধ বা পশ্চিমের নব্য উদারনীতি উন্নয়নশীল বিশ্বের কাছে নতুন কিছু নয়। ঘটনা যাইহোক, যে কোন দেশ বর্তমানে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে। গত এক দশক থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্র স্থানান্তরিত হয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশকে এই প্রক্রিয়ায় অংশীদার করে তুলেছে।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ
বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের কূটনীতিকে বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছে এবং তার নিজস্ব অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং নিরাপত্তা প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে। দেশটিকে বহিরাগত শক্তি, আঞ্চলিক শক্তি এবং এমনকি জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির চাপকে প্রতিহত করতে হবে যাতে বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলতে পারে আমাদের দেশের মাটি কোনো আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক রাজনীতির খেলার মাঠ হতে পারে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এক্ষেত্রে একটি অস্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে যা দেশের শক্তিকে জোরদার করতে সক্ষম। মাত্র ৫০ বছর বয়সে, বাংলাদেশ তার উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের জন্য “এশিয়ার বাঘ”- এই ট্যাগলাইন অর্জন করেছে। স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ঠিক পরে, জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছিল এবং নবজাতক দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে কম জিডিপি-র ১০টি দেশের মধ্যে একটি ছিল। সেসবকে পেছনে ফেলে আজ দেশটি তার বিকাশমান অর্থনীতি এবং দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।
নিঃসন্দেহে, উন্নয়ন প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বাংলাদেশের অবকাঠামো এবং সংযোগের ওপর । এই কারণেই ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সফরের সময় বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) কে স্বাগত জানিয়েছে এবং বিআরআই প্রকল্পের জন্য ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পগুলির জন্য ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। আমাদের অবশ্যই রাখতে হবে (আমাদের) বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বিআরআই সম্পর্কে কথা বলার সময় জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ” আমাদের নিজস্ব আদর্শের মধ্যে আমাদের নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবতে হবে।” পশ্চিম এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ভারতের জন্য যা বোঝা দরকার তা হল বাংলাদেশ কেবল বেইজিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ অন্য কোনো শক্তি বর্তমানে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এত পরিমাণ বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক নয়। এটা স্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতার পার্থক্যের কারণে বেইজিং সম্পর্কে ঢাকার দৃষ্টিভঙ্গি ওয়াশিংটন বা নয়াদিল্লির মত হবে না কিন্তু বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নতি স্বীকার না করে প্রথমে নিজের জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করার অধিকার ঢাকার রয়েছে। চীন এবং দক্ষিণ এশিয়ার উপর কার্নেগি এনডাউমেন্টের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, বেইজিংয়ের প্রভাবের ফলে কিছু দুর্বলতার উদ্রেক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ঋণ-ফাঁদের কোনো হুমকি এখনই নেই। যাইহোক, এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ কাঠামোর ফলাফলগুলিকে মূল্যায়ন করার জন্য বিশ্বাসযোগ্য গবেষণার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশকে অবশ্যই তার জাতীয় স্বার্থের উপর ভিত্তি করে এটির মূল্য এবং সুবিধা বিশ্লেষণ করতে হবে।
সূত্র – blogs.lse.ac.uk
Leave a Reply